কুরআনের বাণীর অনুসরণ ছাড়া নৈতিকতা অবাস্তব

জগতে স্বাভাবিকতা হচ্ছে, মানুষ ঔদাসিন্য ভালোবাসে। আকারে ইঙ্গিতে প্রবৃত্তির চাহিদাকেই জীবন চলার পথের প্রকৃত উপায় ধরে নিয়ে এগোয়। যার নমুনা আজ ইতিহাস নয়, বরং নজীর। আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দারা এই নজীরের সরলিকরণ কল্পে কিতাব প্রাপ্ত হয়েছেন সরাসরি কিংবা পরম্পরায়। মানবতার তেমনি এক চরম দূরবাস্থা থেকে জাতির উত্তোরণ সামনে রেখে আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবকে (সা) জীবন পরিচালনার সর্বশেষ এবং চ‚ড়ান্ত সুমহান আদর্শ দিয়ে সম্মানিত করেন। যিনি সেই আদর্শ রাষ্ট্র পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে জীবনের চরমতম পরীক্ষাগুলোয় উত্তীর্ণ হয়েছেন সবার সামনের কাতারে থেকে। আদর্শের দাওয়াত সর্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে এবং তার গ্রহণযোগ্যতা মনোপ্রিয় করতে এমন যুক্তি মানব মনের গহীনে পৌঁছে দিতে থেকেছেন যে, মনের ব্যাকুলতা দূর করতেই কাতর থাকতো মরু আরবের বাসিন্দারা। যার পরশ ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় আজকের আধুনিক জীবনব্যবস্থা টলটলায়মান।

মানুষের ব্যাকুল মন মৌখতায় পূর্ণ আস্থাশীল হয় না, তাই বাস্তব সাক্ষ্যের দিকে চোখ মেলে ধরে। বাস্তবতার চরম বিষয় হলো নৈতিকতা। আল্লাহর রাসূল (সা) ইসলামী দাওয়াতের গ্রহণযোগ্যতায় উপস্থাপন করেন সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসের প্রকৃষ্ট সব যুক্তি, যা পূর্ণতা এনেছে নৈতকতার স্পষ্টতার মাধ্যমে। যার দরুণ কুরআনের শ্রোতা ও পাঠক প্রত্যেকেই পরিস্কার জানতে পেরেছে যে, ইসলাম কোন ধরনের চরিত্র পছন্দ করে এবং কোন ধরনের অপছন্দ করে। মানবতার কোন সে নমুনা বা আদর্শ তার কাছে মন্দ যা সে পরিবর্তন ও বিলোপ করতে চায়। আর মানবতার এমন কোন সে আদর্শ যা ভালো এবং তা সে তৈরি করতে, লালন ও বিকশিত করতে চায়। মন্দ ও অনিষ্ট তার দৃষ্টিতে কি, কি কারণে তা জন্মলাভ করে এবং মানবজীবনে তা কি কি রূপ ধারণ করে। আর কোন জিনিস তাকে বিকশিত করে। ঠিক তার বিপরীত কল্যাণ তার দৃষ্টিতে কি এবং তার উৎসইবা কি? তার প্রকাশ লাভের পথ কিভাবে উন্মুক্ত হয় এবং কি রূপ ও আকৃতিতে তা প্রকাশ লাভ করে?

সর্বব্যাপী বিস্তৃৃত দাওয়াতে ইসলাম এ কথা নির্দেশ করে যে, ইসলামের উদ্দেশ্যই হচ্ছে অনিষ্ট অকল্যানের যত কারণ তা সমূলে উৎপাটিত করে ফেলা এবং কল্যানের পথ সুগম করে দেওয়া। বেশী বেশী প্রশস্ত করে দেওয়া এবং ব্যক্তি থেকে সমাজ পর্যন্ত জীবনের সকল বিভাগ অকল্যাণের স্থলে কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত করা। এ বর্ণনা ইসলামী দাওয়াতের মধ্যে এতো বিস্তারিত, এতো সুস্পষ্ট, এতো হৃদয়গ্রাহী এবং সাধারণ বিবেক-বুদ্ধির কাছে এতোটা বোধগম্য ভাষায় করা হয়েছে যে, জাহেলিয়াতের সমাজ শত শত বছর ধরে যারা নৈতিক অধঃপতনের অতলতলে নিমজ্জিত ছিল, তাদের জন্যেও একথা উপলব্ধি করা কঠিন ছিল না যে, সত্যি সত্যিই মানবতার সেই নমুনাই সর্বনিকৃষ্ট যাকে ইসলাম মন্দ বলে এবং সেই নমুনাই সর্বোৎকৃষ্ট যার ছাঁচে সে মানুষ ও সমাজকে ঢেলে সাজাতে চায়।

নিরন্তর চলার পথে নৈতিকতা সম্পর্কে কিছু মৌলিক বাস্তবতার বিষয়ে আল্লাহ স্পষ্ট করে দিয়েছেন এভাবে-
‘আর মানুষের নফসের কসম এবং কসম সেই সত্তার যিনি তাকে সুবিন্যস্ত করেছেন। পরে তার পাপ ও পূণ্য উভয়ের প্রবণতা তার মধ্যে ইলহাম করেছেন। নিঃসন্দেহে কল্যাণ লাভ করলো সে যে নফসের পবিত্রতা বিধান করলো এবং ব্যর্থ হলো সে যে তাকে দমিত করে রাখলো। (সূরা শামস : ৭-১০)

মানুষের নফসকে সুবিন্যস্ত করার অর্থ ¯্রষ্টা তাকে এমন দেহ দান করেছেন যা সঠিক আকার-আকৃতি। আপন হাত-পা মনমস্তিষ্কের দিক দিয়ে মানুষের মতো জীবন যাপন করার সম্পূর্ণ উপযোগী। তাকে দেখার, শুনার, স্পর্শ করার, স্বাদ গ্রহণ করার এবং ঘ্রাণ গ্রহণ করার এমন সব ইন্দ্রিয় দান করেছেন, যা স্বীয় অনুপাত ও বৈশিষ্টের ভিত্তিতে জ্ঞান অর্জনের উৎকৃষ্টতম উপায় হতে পারতো। তাকে জ্ঞান বুদ্ধি ও চিন্তা শক্তি, যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, ধারণা শক্তি, স্মরণশক্তি, ভালোমন্দ নির্ণয়ের শক্তি, ইচ্ছাশক্তি এবং অন্যান্য মানসিক শক্তি দান করা হয়েছে যার মাধ্যমে সে দুনিয়ার সে কাজ করার যোগ্য হয় যা মানুষের করণীয়। তাকে স্বভাবজাত দুর্বৃত্ত এবং জন্মগত পাপী হিসাবে নয় বরঞ্চ সঠিক ও সরল প্রকৃতির উপর সৃষ্টি করা হয়েছে। তার গঠন আকৃতিতে কোন প্রকার বক্রতা ও বিকৃতি রেখে দেয়া হয়নি যে, সে সঠিক পথ অবলম্বন করতে চাইলেও তা পারবে না।

মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এমন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন দেহ দান করেছেন যা অন্য কোন প্রাণিকে দান করেননি। আর তাকে চিন্তাভাবনা ও জ্ঞান বুদ্ধির সর্বোত্তম যোগ্যতা দান করেছেন যা অন্য কোন সৃষ্ট জীবকে দান করেননি। কিন্তু যখন সে ঈমান ও নেক আমলের পথ অবলম্বন করার পরিবর্তে আপন দেহ ও মনের শক্তিকে মন্দ পথে ব্যবহার করে, তখন আল্লাহ তাকে মন্দ কাজেরই তওফীক দেন এবং তাকে এমন চরম অধঃপতনে পৌঁছিয়ে দেন যে, কোন নিকৃষ্টতম সৃষ্টিও সে পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে না।

বর্তমান দুনিয়ার এ এমন এক বাস্তবতা যা মানব সমাজে বহু দেখতে পাওয়া যায়। লোভ লালসা, স্বার্থপরতা, আত্মপ্রচারণা, মাদকাশক্তি, নীচতা, ক্রোধান্মত্তাতা এবং এ ধরনের অন্যান্য স্বভাব প্রকৃতির যার মধ্যেই মানুষ নিমজ্জিত হয়, নৈতিক দিক দিয়ে সে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ শুধু একটিকেই যদি সামনে রাখা যায় তাহলে দেখা যায় যে, একটি জাতি যখন অন্য একটি জাতির প্রতি শত্রæতায় অন্ধ হয়ে পড়ে তখন কিভাবে হিং¯্রতায় সকল হিং¯্র প্রাণিকে হার মানায়। হিং¯্র পশু তো শুধু আপন আহারের জন্যে অন্য কোন পশু শিকার করে, সকল পশু একত্রে হত্যা করে না। কিন্তু মানুষ স্বয়ং সমজাতীয় মানুষেরই গণহত্যা করে তুহিন-রাজনদের মতো করে। হিংস্র পশু তার নখর ও দন্তদ্বারা শিকার করে। কিন্তু সর্বোত্তম কাঠামোতে সৃষ্টি করা মানুষ তার বৃদ্ধি ও আবিষ্কার শক্তি দ্বারা একটির পর একটি ধ্বংসাত্মক অস্ত্র তৈরি করতে থাকে যেন গোটা জনপদ ধ্বংস করতে পারে হিরোশিমা কিংবা ইরাকের নমুনায়। হিং¯্র পশু শুধু আহত অথবা হত্যা করে। কিন্তু মানুষ, তার নিজের মতো মানুষকে নির্যাতিত করার জন্যে এমন সব মর্মান্তিক পন্থা অবলম্বন করে যার ধারণা কোন হিং¯্র পশুর মনে আসতে পারে না। অতঃপর সে তার শত্রæতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার লালসা চরিতার্থ করার জন্য নীচতার এমন নিম্নতম স্তরে পৌঁছে যায় যে, নারীদের উলংগ মিছিল বের করে, এক এক নারীকে দশ বিশজন পুরুষ তাদের যৌন ক্ষুধা নিবৃত্ত করার জন্য ধর্ষণ করে। বাপ, ভাই ও স্বামীর চোখের সামনে তাদের কন্যা, ভগ্নি ও স্ত্রীর সম্ভ্রম লুণ্ঠন করে। মা বাপের সামনে তাদের শিশুদেরকে হত্যা করে। মাকে তার সন্তানের রক্ত পান করতে বাধ্য করে। জীবিত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করে মারা হয় এবং জীবিত অবস্থায় দাফন করা হয়।

এইসব বাস্তবতা বর্ণনা করার সাথে সাথে কুরআন মানব মনের তিনটি পৃথক পৃথক রূপ বর্ণনা করেছে।
একটি হলো নফসে আম্মারা যা মানুষকে মন্দ কাজে উত্তেজিত করে। (সূরা ইউসুফ : ৫৩)
দ্বিতীয় নফসে লাওয়ামাহ। তার কাজ হলো মানুষের ইচ্ছা বাসনা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ পর্যন্ত একটি স্তরে সে মানুষকে সতর্ক করে দেয়। তারপর মন্দ কাজ করে ফেলার পর তাকে ভর্ৎসনা করতে থাকে। (সূরা কিয়ামাহ : ২) 
তৃতীয় হচ্ছে নফসে মুতমাইন্নাহ। সে পূর্ণ নিশ্চিন্ততার সাথে মন্দ পথ পরিহার করে সৎ পথ অবলম্বন করে এবং তার এতে কোন দুঃখ নেই যে, সে অসৎ কাজের স্বাদ ও সুযোগ সুবিধা কেন পরিহার করলো এবং কল্যাণের জন্যে কেন বঞ্চনা, ত্যাগ ও কুরবানী, দুঃখ কষ্ট ও বিপ৩দ মসিবত কেন বরদাশত করলো। এতে দুঃখ করা তো দূরের কথা, তার মন এতে সন্তুষ্ট হয় যে, সে মন্দ কাজের আবিলতা ও পংকিলতা থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং কল্যাণের পবিত্রতা সে লাভ করেছে। এ তৃতীয় প্রকারের নফসকে কুরআন খোদার পছন্দনীয় নফস বলে অভিহিত করেছে। তাক জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছে। (সূরা ফজর : ২৭-৩০)

কুরআনে মানবীয় ইতিহাস থেকে এক একটি করে এমন চরিত্র ও আচরণের দৃষ্টান্ত পেশ করা হয় যা ছিলো উন্নতমানের এবং এমন আচরণের দৃষ্টান্তও তুলে ধরা হয় যে, নিকৃষ্টমানের লোক যাতে ভালোভাবে বুঝতে পারে যে, ইসলাম কোন ধরনের মানুষ তৈরি করতে চায়। আর কোন ধরনের মানুষ তার অপছন্দনীয় যার সংশোধন হওয়া উচিত। অথবা তাদের অস্তিত্ব থেকে সমাজকে পবিত্র করে ফেলা উচিত। অথবা শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং যাদেরকে তার গজবের পাত্র বানিয়ে এ দুনিয়াতে ধ্বংস করে দিয়েছেন।

মন্তব্য