এই লেখাটি পড়তে গিয়ে আপনি যদি মনে করেন যে, আমি সংগীতজ্ঞ কিম্বা সংগীত চর্চায় আমার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, তাহলে বড়ো ভুল করবেন। আসলে আমি একজন সংগীত ভালোবাসিয়ে। দারুণ কথামালার ছন্দগুলো যখন জীবনবোধের কথা মনে করিয়ে দেয়, মন মাতানো সুর যখন ঐশি অনুভূতি তৈরিতে সহযোগিতা করে, নান্দনিক তাল-লয় যখন উদ্যমী হওয়ার স্বাপ্নিক হাওয়া লাগায় দেহে; তখন ভালো লাগে।
আপনি গান গাইতে পারেন বলে আপনাকে শিল্পী বলা হবে এমনটা নয়। সকল মানুষ স্বাভাবিকভাবে কবি, শিল্পী না হলেও কম বেশি গায়ক। গান বা সংগীতের সকল কলা জেনে গাওয়াটা মানুষের স্বভাব না। বরং সংগীতে অনভীজ্ঞরাও গান গেয়ে থাকে অবসরে বা সুযোগ পেলেই। গুন গুন করে একা একাই মনের অজান্তে গান গাওয়া আসলে একটা নিত্য স্বভাব। আবার যারা সৃষ্টিকর্তা, তাঁর সৃষ্টি, জীবনবোধ, নিয়ম, নীতি, নৈতিকতা, হাসি, আনন্দ, কান্না, দু:খ, বেদনা, সাফল্য, ব্যর্থতা, দুর্দশা, হতাশা, আশা, আকাংখা, ঋতু বৈচিত্র, জয়-পরাজয়, তারুণ্য, বার্ধক্য, প্রকৃতির সৌন্দর্য্য, জীব বৈচিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের মনে বোধের সঞ্চার করতে সংগীত চর্চা করেন; তারাই আসল শিল্পী। আমরা যারা আম গায়ক, তারা কিন্তু এতো কিছু চিন্তা করে গান গাই না। তাই সকল গায়ককে শিল্পী বলা গেলেও সকল শিল্পীকে গায়ক বলা যায় না।
অনেকসময় আমরা গান, গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটককে বাস্তব জীবনের সাথে মেলানোর চেষ্টা করে থাকি। আসলে এসব বাস্তব নয়, বরং বাস্তবের প্রতিচ্ছবি এবং আবেগ অনুভূতি। আর অনুভূতির ছন্দময় উপস্থাপনই সংগীত। জীবনের বাস্তবতা জীবন ও জ্ঞানে, সংগীতে নয়। জ্ঞানের দ্বারা জীবনায়ন ঘটে, সংগীতের দ্বারা নয়। এর দ্বারা এটা বোঝানো হচ্ছে না যে, আমরা সংগীতের বাইরে থাকতে পারবো। কারণ, সংগীত হৃদয়ে সাড়া জাগায়, আন্দোলিত করে এবং প্রভাবিত করে। নৈতিক উপদেশের চেয়ে সংগীত হৃদয়কে অধিক আলোড়িত করে। অনেক ক্ষেত্রে অনুভূতিকে এতো বেশি জাগ্রত করে যে, তা স্থায়ী হয় দীর্ঘকাল। এসব অনেকসময় মনের অগোচরে বা চিন্তার বাইরেই হয়ে থাকে।
গানের মূল আকর্ষণ বা মাধুর্য সুরের দ্বারা ফুটে উঠে। সংগীতের ছন্দ, তাল এবং লয় যথার্থ হলে তা খুব বেশি অপাঙতেয় হয়ে যায়; এমনটা দেখা যায় না। কিন্তু সুরই গানের আসল বিষয় নয়। আসল বিষয় হলো গানের কথা বা গীত। শ্রোতার কাংখিত চাহিদা গানের মাধ্যমে পূরণ করতে হলে সরল ও সাধারণ কথার প্রয়োজনীয়তা মূলে; অতপর সুর, কণ্ঠ, ছন্দ, তাল, লয়। তারপরো সুর দ্বারা অনেক গান আপনাকে সম্মোহিত করবে ক্ষেত্র বিশেষে। আসলে কথা বা বক্তৃতার চাইতে সুর বা কণ্ঠের কারুকার্য মানব মনকে বেশি আকৃষ্ট করে। সে গানে কথা যাই থাকুক না কেন। আমাদের দেশে আবহমান কাল ধরে তাই দেখা যায়।
ছোটবেলায় রেডিও এবং টেপরেকর্ডারে বাংলা, হিন্দি এবং উর্দু গান শোনার খুব বাতিক ছিলো। কিন্তু কাজটি করতে হতো খুবই গোপনে। কারণ, বাবা-মায়ের কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিলো। পরিবারে ইসলামী সংস্কৃতির আবহ থাকলেও সমাজব্যবস্থার গতানুগতিকতা আর ব্যক্তিগতভাবে তখনো ইসলামী চেতনা বোধ তৈরি না হওয়ায় বুঝতে পারতাম না, নিষেধের মূল বিষয় কী ছিলো! দ্বীনি চর্চার মধ্য দিয়ে বড় হতে থাকলেও ইসলামের মূল মর্ম বুঝতে শুরু করেছি ১৪ বছর বয়স থেকে। সংস্কৃতি সম্পর্কেও ধারণার শুরু মূলত: সেখান থেকেই। তখন বাবা-মায়ের বাধার প্রকৃত কারণ জেনেছিলাম।
গান-বাজনার প্রতি তখনকার সেই আকর্ষণ ছিলো কথা, কণ্ঠ, সুর এবং বাদ্যযন্ত্রের সম্মোহনিতে। আমার বিশ্বাস, আমার মতো এই ম্যানিয়াতে অনেকেই ভুগেছেনে বা ভুগছেন। এটারো একটা বিশেষ কারন আছে। তা হলো আমাদের নফসে শয়তানের প্রভাব মূলত বেশি। শয়তান আমাদের মনে ফাসেকি বিষয় ঢুকিয়ে দেয় চমৎকারভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে। এককথায় শয়তানের পক্ষ থেকে তা আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয় আমাদের মন কেড়ে নেওয়ার জন্য। যেই গানের কথায় নৈতিকতার কোন বালাই নেই, দেখবেন তার প্রতি মনের টান একটু বেশিই। আর কেন জানি সেই গানের সুর, তাল, লয় এবং সংগীতায়নো চমৎকার হয়। তার দ্বারা অনেক ক্ষেত্রে জাগতিক উপায় উপকরণে আসক্ত হওয়ার প্রবণতাই বেশি উপলব্ধ হয়।
গানের ভালো মন্দ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভর করে গীতিকার এবং গায়কের উদ্দেশ্যের উপর। যৌনানন্দ ও মাদকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গানের সংগীতায়ন হলে এক প্রকারের উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে। যদি গানের উদ্দেশ্য হয় মনুষ্যত্বের বিকাশ, সে ক্ষেত্রে ভিন্ন উদ্দেশ্য সাধিত হয়। গায়কের উদ্দেশ্য হতে পারে শুধুমাত্র শ্রোতার যাপিত জীবনের একঘেয়ে ভাব দূর করতে চিত্তবিনোদন, জীবনধারার পরিবর্তন অথবা শ্রোতার জীবনকে পরিবেশের সংগে মানিয়ে নেওয়া। উত্তম মানের গান শ্রোতাকে আনন্দ দেয় ও অনুপ্রাণিত করে। শ্রোতার জীবনের গতিধারা পরিবর্তন করে দিতে পারে, যদি গানের কথা-সুর সে মানের হয়। আমি যদি গানের দ্বারা নৈতিকতার বিকাশ ঘটাতে চাই, তাহলে তাই হবে; অনৈতিকতার বীজ মনে বপিত হবে না। বর্তমান ছায়াছবির গান এবং এই ঘরণার গানের মান যাচাই করার পূর্বেই মুমিন মাত্রই কানে শ্রুত হওয়ার সাথে সাথেই বুঝতে পারা সম্ভব হয় যে, কিসের দিকে আমাদের হৃদয়কে টানছে। অন্যদিকে জীবনবোধের সংগীত চর্চার বিষয়টিও আজকাল অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পেশাদারিত্বে রূপ নিয়েছে। গান লিখে বা গেয়ে যশ-খ্যাতি আর অর্থ উপার্জন টার্গেটে পরিণত হয়েছে। দ্বীনি অনুভূতির পূর্ণ অনুশীলন থেকে সংগীত চর্চায় ঘাটতিও কম দেখা যায় না। আসলে এই বিষয়টি যতোটা না অনুভূতির আভাবে হয়, তারচেয়েও বেশি হয় জ্ঞানের ঘাটতির কারণে।
ইসলাম যে মহান আল্লাহর মনোনীত একমাত্র এবং সর্বশেষ পথের দিশা, তা নিয়ে পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম ব্যক্তিদের অনেকই হীনমন্যতায় ভুগে থাকেন। বিশেষ করে বর্তমানে ইসলামের অনুসারী ইউটিউব এবং ফেসবুক-টুইটারে আত্মাসক্ত তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ একথার উপর আমল শুরু করে দিয়েছে যে, ১৪০০ বছর আগের ইসলাম আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের যুগে অনেকটা সেকেলে এবং গোড়া জীবনাদর্শ। আর এ-ও ধারণা তাদের যে, মুসলিমরা শিল্পকলা, সংগীত, নাটক ইত্যাদির প্রতি অতীতে ছিলো শত্রুভাবাপন্ন এবং বর্তমানেও উদাসীন। তাদের এই চিন্তা মূলত জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে হয়েছে। বিশেষ করে পৃথীবিতে মানুষের আগমনের উদ্দেশ্য এবং এর কার্যকরণ কী, তার ব্যাপারে উদাসীনতা। নিজের গ-িকে ছোট করে ফেলা। সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে পাওয়া সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের ব্যাপারে ধারণা না রাখার কারণে সংস্কৃতির চর্চা ক্ষেত্রেও তার প্রভাবে অন্যদের প্রভাবিত করে।
দ্বীনকে দ্বীনি অনুভূতি সহকারে এবং দ্বীনি মানসিকতা থেকে দেখতে শুরু করলে আমাদের মনে আস্তে আস্তে প্রশান্তি আসতে শুরু করবে, এটাই সত্য। তখন আমরা দেখতে পাবো যে, সংস্কৃতি নিয়ে আমার মনের ব্যাকুলতা দূর হয়ে যাচ্ছে। আসলে ইসলামের ব্যাপকতা আমরা দেখতে পাই না অনেক সময়। ইসলামী সংস্কৃতিতো আমাদেরকে সামাজিকতার এক দৃঢ় কাঠামোর দিক নির্দেশ করে। যেখানে মহান আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার মাধ্যমে মানবিক স্থিতিশীলতা আনে। এর বৈশিষ্ট্যই তো হলো- সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদে বিশ্বাস, মানবতার প্রতি সম্মানবোধ, বিশ্বব্যাপকতা ও সার্বজনীনতা, ভ্রাতৃত্ব, বিশ্ব শান্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ঐক্য, কর্তব্য ও দায়িত্বের অনুভূতি, পবিত্রতা পরিচ্ছন্নতা, পংকিলতা মুক্ত হওয়া, ব্যক্তি সাতন্ত্র্যের মর্যাদা, ভারসাম্যতা, সুষমতা এবং সাম্য। তাহলে জীবনের কোন দিকটিকে ইসলাম সেকেলে করে রাখতে নির্দেশ করছে আমাদের?
আমাদের জীবনতো আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত। আল্লাহর রং-এ জীবন সাজাতে পিছপা হবো কেন তাহলে! সংস্কৃতির এই অঙ্গন যেন পংকিলতা এবং কলুষতা মুক্ত হয় তার জন্য আমরা আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করতেই পারি মুমিন হিসেবে। তখন সংগীতের চর্চা আল্লাহমুখিতা, পবিত্রতা ও নৈতিকতাবোধ, মানবতাবোধ এবং সৌন্দর্যবোধের সাথে হবে। সেই ক্ষণ থেকে হৃদয়ে ঐশি অনুভূতি তৈরি হবে, নান্দনিকতায় ভরপুর হবে প্রতিটি ভোর, উদ্যমী হওয়ার স্বাপ্নিক হাওয়া লাগবে দেহে।
মন্তব্য